Ticker

5/recent/ticker-posts

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের বর্ণনা

"বস্তুতঃ আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো।" -[ক্বুরআন ৩ : ১২৩]

আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেন-
"স্মরণ করো, সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ‌ তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দু’টি দলের মধ্য থেকে একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা দুর্বল দলটি লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের শিকড় কেটে দেবেন। যাতে করে সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা অসন্তুষ্ট হয়।" -[ক্বুরআন ৮ : ৫-৮]

ইবনে ইসহাক বলেন, বদর যুদ্ধের ঘটনা আমার নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব, আসিম ইবনে উমার ইবনে কাতাদা, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর ও ইয়াজীদ ইবনে রুমান- এরা সবাই বর্ণনা করেছেন উরওয়া ইবনে যুবায়র থেকে। আর অন্যান্য আলিমগণ বর্ণনা করেছেন ইবনে আব্বাস থেকে। এদের প্রত্যেকই ঘটনার এক এক অংশ বর্ণনা করেছেন। আর তা থেকেই বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত রূপ নিচে বর্ণিত হল-

তাদের বর্ণনা এরুপ- রাসূলুল্লাহ (সা) যখন শুনতে পেলেন যে, আবূ সুফিয়ান সিরিয়া থেকে রওনা হয়ে এদিক আসছে, তখন তিনি মুসলিমদেরকে তার বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন এবং বললেন, কুরাইশদের এ কাফেলায় তাদের বহু ধনসম্পদ রয়েছে। তোমরা এগিয়ে যাও, হয়তো আল্লাহ্ ঐ ধন-সম্পদ তোমাদেরকে দিয়ে দিবেন। লোকজন রাসূলুল্লাহ (সা) এর আহ্বানে সাড়া দিল। তবে কিছু লোক দ্রুত হাজির হল আর কিছু লোক দ্বিধাবোধ করছিল। এর কারণ হচ্ছে, এ লোকগুলো বুঝতে পারছিল না যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কোন যুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা! আবু সুফিয়ানের কাছে জনগণের সম্পদের দায়িত্ব থাকায় ঝুঁকি এড়ানোর জন্যে হিজাযের নিকটবর্তী এসে যে কোন আরোহীর সঙ্গে দেখা হলেই সে তার থেকে গোপন সংবাদ নিতে থাকে। অবশেষে জনৈক আরোহী তাকে জানালো যে, মুহাম্মদ তার অনুসারীদেরকে তোমার ও তোমার কাফেলার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান সাবধানতা অবলম্বন করল এবং যমযম ইবনে আমর গীফারীকে তখনই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল যে- কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলবে, মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে তোমাদের কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়েছেন, তাই তারা যেন তাদের সম্পদ রক্ষার্থে একদল সশস্ত্র লোক পাঠিয়ে দেয়। যমযম দ্রুত মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

গিফারী মক্কার উপকণ্ঠে বাতনে ওয়াদীতে এসে উটের নাক কেটে হাওদা উলটিয়ে এবং জামা ছিঁড়ে ফেলে উচ্চঃস্বরে চিৎকার দিয়ে বলছিল- হে কুরাইশ জনগণ! বিপদ! বিপদ!! আবু সুফিয়ানসহ তোমাদের মালামাল লুট করার জন্যে মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা আক্রমণে বেরিয়েছেন। আমার মনে হয়, তোমরা আর তা রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্যের জন্যে আগাও! সম্পদের জন্যে আগাও! ছুটে যাও।

ইবনে ইসহাক বলেন, ইয়াযীদ ইবনে রূমান আমার নিকট উরওয়া ইবনে যুবায়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কুরাইশরা যুদ্ধে রওনা হওয়ার প্রাককালে বনূ বকরের সাথে তাদের বিরোধের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ভাবতে থাকে। ঠিক ঐ মূহর্তে ইবলিশ সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুশাম মুদলাজির আকৃতি ধারণ করে তাদের সামনে হাযির হয়। সে কুরাইশদের বলল, বনূ কিনানের লোকেরা যাতে পশ্চাৎ দিক থেকে তোমাদের উপর হামলা না করে আমি তার দায়িত্ব গ্রহণ করছি। এ প্রতিশ্রুতি পেয়ে কুরাইশরা দ্রুত যুদ্ধে রওনা হয়ে গেল।

অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর অভিযান সম্পর্কে ইবনে ইসহাক বলেন: রমাযান মাসের কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে অভিযানে বের হন। ইবনে উম্মে মাকতুমকে তিনি লোকদের নামাজের ইমামতীর দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর রাওহা থেকে আবু লুবাবাকে মদীনার শাসক নিযুক্ত করে ফেরত পাঠান। মুসআব ইবনে উমায়রের হাতে যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করেন। উমাবী বলেন, মুসলিম বাহিনীতে দু'টি মাত্র ঘোড়া ছিল। তার একটির আরোহী ছিলেন মুসআব ইবনে উমায়র এবং অপরটিতে আরোহণ করেছিলেন যুবায়র ইবনে আওআম (রা)। ইবনে ইসহাক বলেন, মুসলিম বাহিনীতে সেদিন সত্তরটি উট ছিল, যাতে তারা পালাক্রমে আরোহী করতেন।

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা থেকে মক্কার পথে উঠে মদীনার বাইরের গিরিপথ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং পর্যায়ক্রমে আকীক, যুল-হুলায়ফা, উলাতুল জায়শ, তুরবান, মালাল, গামীসুল-হুমাম, সখীরাতুল-ইয়ামামা, সায়ালা হয়ে ফাজ্জুর রাওহাতে পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি শানুকার সমতল পথ ধরে চলতে লাগলেন।

যাফরান নামক উপত্যকা আড়াআড়িভাবে পাড়ি দিয়ে যখন যাত্রা বিরতি করেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সংবাদ পেলেন যে, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলা রক্ষার্থে প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তিনি তাঁর সাথীগণকে এ বিষয়ে অবহিত করেন এবং এখন কী করা উচিত সে সম্পর্কে তাদের থেকে পরামর্শ আহ্বান করেন। আবূ বকর সিদ্দীকি (রা:) উঠে চমৎকারভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। এরপর উমার ইবনে খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠভাবে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। এরপর মিকদাদ ইবনে আমর দন্ডায়মান হন। তিনি বলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্ আপনাকে যা করতে নির্দেশ দেন আপনি তাই করুন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম, আমরা আপনাকে সে কথা বলবো না, যে কথা বনী ঈসরাইলরা মূসা (আ) কে বলেছিল। তারা বলেছিল, আপনি আর আপনার প্রতিপালক যুদ্ধে যান, আমরা এখানে বসে থাকলাম। কিন্তু আমরা বলছি- আপনি ও আপনার প্রতিপালক যুদ্ধে যান, আমরাও আপনাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করবো। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সদূর বারকূল গিমাদেও যেতে চান, তবে আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে সেখান পর্যন্ত পৌঁছবো। রাসূলুল্লাহ (সা) মিকদাদের প্রশংসা করলেন এবং তার মঙ্গলের জন্য দু'আ করলেন।

এরপর তিনি উপস্থিত লোকদের কাছ থেকে পুনরায় পরামর্শ আহ্বান করলেন। তিনি মনে মনে চাচ্ছিলেন যে, আনসারদের মধ্য হতে কেউ কিছু বলুক। তখন সাআদ ইবনে মুআয উঠে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আপনি সম্ভবত আমাদের (আনসারদের) দিকে ইঙ্গিত করছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। সাআদ বললেন- আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি। আপনার দাওয়াতকে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। আপনি যে বিধি-বিধান নিয়ে এসেছেন তার সত্যতার উপর সাক্ষ্য দিয়েছি এবং এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আপনার নিকট অংগীকার করেছি ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি যে, আপনার কথা শুনবো ও আপনার আনুগত্য করবো। সুতরাং ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যা সংকল্প করেছেন তাই করুন! আমরা আপনার সঙ্গে আছি। সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সমুদ্রে যান এবং তাতে ঝাঁপ দেন, তবে আমরাও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বো এবং আমাদের একটি লোকও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না। আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে আগামীকাল শত্রুর মোকাবেলা করতে চান, তবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যুদ্ধে আমরা ধৈর্যশীল এবং শত্রুর মোকাবেলায় অটল থাকবো। হতে পারে আল্লাহ্ আমাদের দ্বারা এমন বীরত্ব দেখাবেন, যা দেখে আপনার চোখ জুড়াবে।

সাআদ -এর এ বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত আনন্দিত এবং উৎসাহিত বোধ করলেন। এরপর সবাইকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, তোমরা সম্মুখে অগ্রসর হও এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা, আল্লাহ্ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দু'দলের একদল আমাদের করায়ত্ত হবে। আল্লাহর কসম, শত্রুদের মধ্যে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হবে, তাদের সেই স্থানগুলো যেন আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি।

ইবনে ইসহাক বলেন, কুরায়শ বাহিনী (যুদ্ধের দিন) সকাল বেলা তাদের অবস্থান থেকে রণাংগনের দিকে বেরিয়ে এলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন:
হে আল্লাহ্! এই সে কুরাইশ- যারা অশ্ববাহিনী নিয়ে দর্পভরে এগিয়ে আসছে। এরা আপনার বিদ্রোহী এবং আপনার রাসূলকে অস্বীকারকারী। হে আল্লাহ্! আমি আপনার সেই সাহায্যের প্রত্যাশী যার প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন। হে আল্লাহ্! এই সকাল বেলায় আপনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিন।

ইমাম আহমাদ বলেন: উমার ইবনে খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবাগণের প্রতি লক্ষ্য করেন। তাদের সংখ্যা ছিলো তিনশ'র কিছু বেশি। এরপর তিনি মুশরিকদের প্রতি লক্ষ্য করেন। ওদের সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) চাদরমুড়ি দিয়ে কিবলামুখী হন এবং দু'আ পাঠ করেন-
হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করেন। হে আল্লাহ্! আজ যদি ইসলামের এ দলটিকে আপনি ধ্বংস করেন তাহলে পৃথিবীর বুকে আর কখনও আপনার ইবাদাত করা হবে না।

অতঃপর চুড়ান্ত যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিম বাহিনীর বিশাল বিজয় অর্জিত হয়। এমনকি ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মুসলিম বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যেমনটি আল্লাহ্ তা'আলা বলেন-
যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার ফেরেশতাদিগকে নির্দেশ দান করেন যে, আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি, অতএব মুমিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ করে রাখ। অচিরেই আমি কাফিরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই তাদের স্কন্ধে আঘাত হান, আঘাত হান প্রত্যেকটি আঙ্গুলের গিঁটে গিঁটে। যেহেতু তারা অবাধ্য হয়েছে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের, সেজন্য এই নির্দেশ। বস্তুতঃ যে লোক আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্য হয়, নিঃসন্দেহে আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। -[ক্বুরআন ৮ : ১২-১৩]


 তথ্যসূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খণ্ড




 প্রাসঙ্গিক বিষয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ